স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশ
আজ থেকে ৫০ বছর আগে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতি এই কাঙ্খিত স্বাধীনতা অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম লাভ করে বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্র।
স্বাধীনতা দিবস, এই দিনটি বাঙালি জাতির সংগ্রামমুখর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। ১৯৭১ সালের এই দিন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
এবারের স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ তাৎপর্য হচ্ছে, এ বছর স্বাধীনতার ৫০ বছর, রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত হচ্ছে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। এ উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানরা ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে আসছেন। অংশ নিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর যৌথ অনুষ্ঠানে। গত ১৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ১০ দিন ব্যপী বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। তবে সুবর্ণ জয়ন্তীর উদযাপন উপলক্ষে আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজন করা হবে।
১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত যাওয়ার পর দীর্ঘ ১৯০ বছরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শোষণ ও নির্যাতনের হাত থেকে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ মুক্তি পেলেও পূর্ব বাংলার বাঙালির ওপর জেঁকে বসে নতুন জান্তা। ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি জিন্নাহর ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ভারত থেকে আলাদা হয়ে পাকিস্তান নামের একটি অসম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এর মধ্য দিয়ে শুরু থেকে বাঙালির জীবনে আবারও নেমে আসে শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতনের স্টিম রোলার। ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে স্বাধীন হলেও এই ভূখণ্ডের বাঙালি আবার পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।
তবে থেমে থাকেনি বাঙালি জাতি। ঔপনিবেশিক পাকিস্তানের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ বাঙালি জাতি শুরু থেকেই অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নামে। পাকিস্তানের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসতে ধাপে ধাপে আন্দোলন গড়ে ওঠে। মাহন ভাষা আন্দোলন, ৫৪ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০- এর নির্বাচনসহ দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতি ৭১ সালে এসে উপনীত হয়। অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন স্বাধীকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। আর বাঙালির এ আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের এক পর্যায়ে এ স্বাধীকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। ধারাবাহিক আন্দোলনকে স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর করে নিয়ে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে তিনি ভূষিত হন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে।
অপরিসীম সাহস, দৃঢ়চেতা মনোভাব ও আপসহীন নেতৃত্ব দিয়ে বঙ্গন্ধু পরাধীন বাঙালি জাতিকে সংগ্রামী হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের (তৎকালীন রেসকোর্স) বক্তব্যে বাঙালির মধ্যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলে স্বাধীনতা অর্জনে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মরণপণ সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিলেন তিনি। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার চূড়ান্ত নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। আর পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী আলোচনার নামে প্রহসন চালাতে থাকে।
এর এক পর্যায়ে ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আধুনিক অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করে। অপারেশন সার্চ লাইটের নামে শুরু করে নির্বিচারে গণহত্যা। এই গণহত্যা শুরু হওয়ার পরপরই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। এই ঘোষণার বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। তাৎক্ষণিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলার সর্বস্তরের মানুষ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুধু এ দেশের জনগণই নয়, আক্রান্ত জাতি ও সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং বাংলাদেশের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয় প্রতিবেশী দেশ ভারত। মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র, আশ্রয় ও খাদ্য দিয়ে সহায়তা করে ভারত। এই সময় আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশাল ভূমিকা রাখে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া)। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই ভূমিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আরও ত্বরান্বিত করে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুক্তিকামী ও গণতন্ত্রকামী মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী ও বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি বিজয় লাভ করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

সমকালীন বিশ্বে দেশরত্ন শেখ হাসিনা এমন এক রাষ্ট্রনায়ক যিনি কেবল বাংলাদেশের তৃতীয় দফা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বেই নিয়োজিত নন, তিনিই একমাত্র রাজনীতিবিদ যিনি টানা ৩৬ বছর ধরে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তার নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কর্তব্য সম্পাদন এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন রূপায়নে বাঙালি জাতির ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল নতুন অধ্যায় যুক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জাতির পিতার রক্তে রঞ্জিত পিচ্ছিল ও বন্ধুর পথ ধরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন।
শিক্ষা জীবনঃ
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। তার মাতার নাম বেগম ফজিলাতুননেসা। তিনি টুঙ্গিপাড়ায় বাল্যশিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সাল থেকে তিনি ঢাকায় পরিবারের সাথে মোগলটুলির রজনীবোস লেনের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। পরে মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে ওঠেন। ১৯৫৬ সালে তিনি টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে তিনি আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৬৭ সালে গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (বর্তমানে বদরুননেসা সরকারি মহিলা কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। বিয়ের কারণে স্বাভাবিক শিক্ষাজীবনে ছেদ পড়ায় তাকে অনার্স পাঠ স্থগিত রাখতে হয়। পরে ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
রাজনৈতিক জীবনঃ
ছাত্র রাজনীতিঃ স্কুলজীবনেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। ১৯৬২-তে স্কুলের ছাত্রী হয়েও আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকে তার নেতৃত্বে মিছিল গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৬৬-৬৭ শিক্ষাবর্ষে কলেজ ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবনের পথ চলা। ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ও রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক হন।
মূলধারার রাজনীতিঃ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভয়াল রাত্রিতে সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলেও তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা। পরবর্তী ছয় বছর লন্ডন ও দিল্লিতে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয় তাদের দুই বোনকে।
১৯৮১ সালে সর্বসম্মতিক্রমে শেখ হাসিনাকে তার অনুপস্থিতিতেই আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু-কন্যা ঐক্যের প্রতীক হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দীর্ঘ ছয় বছর পর যখন বাংলার মাটিতে পা দেন। লাখ লাখ মানুষ তেজগাঁও বিমানবন্দরে সমবেত হয়ে তাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানায়। ১৯৮১ সালের ১২ জুন শেখ হাসিনার কাছে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি হস্তান্তর করা হয়। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতায় আরোহনকে অবৈধ ঘোষণা করে এরশাদ-বিরোধী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন শেখ হাসিনা। ১৯৮৩ সালে তিনি ১৫ দলের একটি জোট গঠন করেন। তার নেতৃত্বে দেশজুড়ে সামরিক শাসক এরশাদ-বিরোধী দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠায় ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের ৩১ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। চোখ বেঁধে তাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়।
১৯৮৪ সালে তিনি আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের কংগ্রেসে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৫ সালে ইয়াসির আরাফাতের আমন্ত্রণে তিউনেশিয়ায় ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (PLO) সদর দফতর সফর এবং মধ্যপ্রাচ্য শান্তি-প্রক্রিয়ার বিষয়ে মতবিনিময় করেন।১৯৮৬-র সংসদ নির্বাচনে তিনি সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালের ৩ জানুয়ারি শেখ হাসিনা পুনরায় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন।
১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর শেখ হাসিনাকে গৃহে অন্তরীণ রাখা হয়। ১৯৮৭ সালে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউশন ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স নামে সংগঠনের আমন্ত্রণে শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোয় অনুষ্ঠিত নারী নেত্রীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেন বিশেষ অতিথি হিসেবে। ১৯৮৮ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের সপ্তম কংগ্রেসে তিনি পাঠ করেন ‘নিরস্ত্রীকরণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ। একই বছর যোগদান করেন বিশ্বশান্তি পরিষদের সভাপতিম-লীর সদস্য হিসেবে প্রাগে অনুষ্ঠিত প্রেসিডিয়াম বৈঠকে।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মিছিলে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পুলিশ ও বিডিআর এলোপাতাড়ি নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় অল্পের জন্য শেখ হাসিনার জীবন রক্ষা হলেও নিহত হন ৯ সাধারণ নেতা-কর্মী-সমর্থক। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর আন্দোলনের জোয়ার ঠেকাতে সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় এবং শেখ হাসিনাকে ধানমন্ডির বাসায় গৃহবন্দী অবস্থায় রাখা হয়। ৪ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত জনসভায় ভাষণ দেন শেখ হাসিনা। এরশাদের পতন ঘটে।
১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সংসদ উপনির্বাচনের সময় সন্ত্রাসীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর তিনি সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালের ৭ মার্চ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১০০ সংসদ সদস্য শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গোলাম আযমকে গণ-আদালতে বিচারের দাবির সঙ্গে একাত্ম ঘোষণা করেন। ১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল করে গোলাম আযমের বিচার করার প্রস্তাব দেন শেখ হাসিনা। ১৯৯২ সালের ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলনে পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
১৯৯২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি পরিষদের আন্তর্জাতিক সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন তিনি। ওই একই বছর যোগদান করেন নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ডেমোক্রেটিক পার্টির কনভেনশনে। ১৯৯২ সালে তিনি গৌতম বুদ্ধের কর্ম ও চিন্তাধারার ওপর অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনার উপলক্ষে নেপাল এবং ওই একই বছর পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত সার্ক দেশগুলোর পার্লামেন্টের বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দের সভায় যোগদান করেন। ১৯৯৩ সালে চীন সফর করেন শেখ হাসিনা।
১৯৯৩ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার সভায় গুলি ও বোমা হামলায় ৫০ জন আহত হন।
১৯৯৩ সালের জুন মাসে ভিয়েনার মানবাধিকারের ওপর দ্বিতীয় বিশ্ব কংগ্রেসের আগ মুহূর্তে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক এনজিও সম্মেলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। ১৯৯৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত ‘ন্যাশনাল প্রেয়ার ব্রেকফাস্ট’ অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করেন সম্মানিত অতিথি হিসেবে। একই বছর টোকিওতে অনুষ্ঠিত সোশিয়ালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সেমিনারে যোগদান করেন তিনি। ১৯৯৪ সালে তিনি ‘ইস্টার্ন ভিশন ফেয়ার’র ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীনতার সূতিকাগার জাতির পিতার ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক বাসভবনটি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে’ রূপান্তর করে তা দেশবাসীর উদ্দেশে উৎসর্গ করেন। ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার ট্রেন অভিযাত্রায় ঈশ্বরদী ও নাটোরে ব্যাপক সন্ত্রাস, গুলি, বোমা হামলা ও তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। এ ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশসহ আহত হন শতাধিক। ১৯৯৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা মিন্টো রোডের বিরোধীদলীয় নেতার বাসভবন ত্যাগ করেন। ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় সংসদ থেকে আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি বিরোধী দলের সদস্যরা একযোগে পদত্যাগ করেন। তার নেতৃত্বে খালেদা সরকারের ভোট কারচুপি ও জনগণের ভোটাধিকার হরণের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে তীব্র আন্দোলন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির একদলীয় নির্বাচনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়ে খালেদা সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। ১৯৯৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে ভাষণ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর (১৯২০-১৯৭৫) জাতির জনক এবং বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি (২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১১ জানুয়ারি ১৯৭২)। শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন গোপালগঞ্জ দেওয়ানি আদালতের সেরেস্তাদার। মুজিব ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন। তিনি স্থানীয় গীমাডাঙ্গা স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। চোখের সমস্যার কারণে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা চার বছর ব্যাহত হয়। ১৯৪২ সালে তিনি গোপালগঞ্জ মিশনারী স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৪৪ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে আই.এ এবং একই কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে বি.এ পাশ করেন।
বিশ শতকের ষাটের দশকের প্রথমদিকে শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিতে প্রাধান্য লাভ করেন। অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার দ্বারা শেখ মুজিব আওয়ামী লীগকে আন্তঃদলীয় রাজনীতি থেকে মুক্ত করে দলের মূল স্রোত থেকে কিছু কিছু উপদলের বেরিয়ে যাওয়া রোধ করতে সক্ষম হন। সম্মোহনী শক্তিসম্পন্ন সংগঠক শেখ মুজিব দলের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পেরেছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি তাঁর বিখ্যাত ছয়দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন এবং এই ছয় দফাকে আখ্যায়িত করেন ‘আমাদের (বাঙালিদের) মুক্তি সনদ’ রূপে। দফাগুলো হলো : ১. ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন এবং সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন; ২. প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র ব্যতীত অপর সকল বিষয় ফেডারেটিং ইউনিট বা প্রাদেশিক সরকারগুলির হাতে ন্যস্ত করা; ৩. দুই রাষ্ট্রের জন্য পৃথক মুদ্রা চালু করা অথবা পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; ৪. করারোপের সকল ক্ষমতা ফেডারেটিং রাষ্ট্রগুলির হাতে ন্যস্ত করা; ৫. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহকে স্বাধীনতা প্রদান; ৬. রাষ্ট্রসমূহকে নিজের নিরাপত্তার জন্য মিলিশিয়া বা আধা সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা প্রদান করা। সংক্ষেপে এ কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে রাজনীতির প্রতি তাঁর এক নূতন দৃষ্টিভঙ্গী উন্মোচিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ছয়-দফা কর্মসূচীর অর্থ ছিল কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বাধীনতা। সকল রাজনৈতিক দলের রক্ষণশীল সদস্যরা এ কর্মসূচীকে আতঙ্কের চোখে দেখলেও এটা তরুণ প্রজন্ম বিশেষত ছাত্র, যুবক এবং শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে নূতন জাগরণের সৃষ্টি করে।
মুজিব কর্তৃক ছয়দফা কর্মসূচীর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার পর আইয়ুব সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করে। শেখ মুজিব এবং আরও চৌত্রিশ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করা হয়। সরকারিভাবে এ মামলাটির নাম দেয়া হয় ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’। মামলায় অভিযুক্তদের অধিকাংশই ছিলেন পাকিস্তান বিমান এবং নৌবাহিনীর বাঙালি অফিসার এবং কর্মচারী। এদের মধ্যে তিনজন ছিলেন উর্দ্ধতন বাঙালি বেসামরিক কর্মকর্তা। মুজিব ইতোমধ্যে কারারুদ্ধ থাকায় তাঁকে এক নম্বর আসামী হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হয়। এ মামলায় শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তিনি অন্যান্য আসামীর যোগসাজশে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। অভিযোগ মতে শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য আসামী ভারতের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানকে বলপূর্বক বিচ্ছিন্ন করার গোপন পরিকল্পনা করছিলেন। পাল্টা আঘাত হানার এ চালটি অবশ্য বুমেরাং হয়েছিল। ঢাকা কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলাটির বিচার চলছিল যেটা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তানের আধিপত্যবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে বাঙালিদের আবেগ অনুভূতিকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারের সময় মুজিবের জনমোহিনী রূপ আরোও বিকশিত হয় এবং সমগ্র জাতি তাদের নেতার বিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ১৯৬৯ সালের প্রথমদিকে বিশেষত তরুণ প্রজন্মের দ্বারা সংগঠিত গণআন্দোলন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে আইয়ুর সরকার দেশে আসন্ন একটি গৃহযুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টায় মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়। শেখ মুজিব ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নিঃশর্ত মুক্তিলাভ করেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ মুজিব রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষ লোকের বিশাল জমায়েতে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন যা বাঙালি জাতির ইতিহাসে যুগ সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। মুজিব তাঁর ভাষণে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে ব্যর্থ সামরিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ আনেন। বক্তৃতার শেষে মুজিব ঘোষণা করেন: ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে... মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দলের সাথে আলোচনা শুরু করতে ১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন। পরদিন থেকে আলোচনা শুরু হয়, যা মাঝেমধ্যে বিরতিসহ ২৫ মার্চ সকাল পর্যন্ত চলে। এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন এবং লাগাতার হরতাল চলছিল। মার্চের ২ তারিখ থেকে ছাত্র এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে থাকেন এবং এ ধারা অব্যাহতভাবে চলে। এ পটভূমিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের নামে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন স্থানে পৈশাচিক তান্ডব চালিয়ে ছাত্র-শিক্ষক এবং নিরীহ লোকদের গণহারে হত্যা করে। এভাবে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী দীর্ঘ নয় মাস ধরে গণহত্যা চালিয়ে যায়। শেখ মুজিবকে ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখা হয় এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বিদ্রোহে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে বিচারের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে তা সম্প্রচারের জন্য ইপিআর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে চট্টগ্রামে এক ওয়্যারলেস বার্তা পাঠান। তাঁর ঘোষণাটি নিম্নরূপ:
‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ হতে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমার আহবান, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং যার যা কিছু আছে তা দিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করুন। বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বিতাড়িত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের এ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’
২৫ মার্চ পাকবাহিনীর হামলার পর থেকে যে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয় সে সময় বঙ্গবন্ধু যদিও পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী ছিলেন তথাপি তাঁকে তাঁর অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকার নামে অভিহিত অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য জনপ্রতিনিধিরা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল এ সরকার গঠন করে। তাঁকে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কও করা হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের গোটা অধ্যায়ে শেখ মুজিবের অনন্য সাধারণ ভাবমূর্তি মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা এবং জাতীয় ঐক্য ও শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে।
পাকিস্তানি জান্তা বঙ্গবন্ধুর বিচার করে মৃত্যুদন্ডাদেশ দিলে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ তাঁর জীবন বাঁচাতে উদ্যোগী হন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি দখলদারী থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবকে পাকিস্তানি কারাগার হতে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি লন্ডন হয়ে বিজয়ীর বেশে স্বদেশ প্রর্ত্যাবর্তন করেন। সারা দেশে আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে যায়। সমাজের সর্বস্তরের লাখো জনতা তেজগাঁ পুরাতন বিমানবন্দরে তাঁকে বীরোচিত অভ্যর্থনা জানায়। নতুন প্রজাতন্ত্রের নেতৃত্বকে ঘিরে এবং সেই সূত্রে বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে যে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ জমে উঠেছিল তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে তা তিরোহিত হয়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকার ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল : ‘শেখ মুজিব ঢাকা বিমানবন্দরে পর্দাপণ করা মাত্র নতুন প্রজাতন্ত্র এক সুদৃঢ় বাস্তবতা লাভ করে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে প্রথম সরকারের মাত্র সাড়ে তিন বছরের সংক্ষিপ্ত সময়টুকু নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। শূণ্য থেকে শুরু করে তাঁর সরকারকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশের অগণিত সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং জাতিগঠন কার্যক্রম শুরু হয়। আইন শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃনির্মাণ, মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীদের জনরোষ থেকে রক্ষা করা এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করা এবং আরো অনেক সমস্যার সমাধান তাঁর সরকারের সামনে সুবিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।